
মিয়ানমারে সামরিক জান্তা সরকার আবারও নিজেদের হারানো এলাকা পুনর্দখলে সফলতা অর্জন করছে। চীনের সরাসরি সহায়তায় সেনাবাহিনী এখন বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালীভাবে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ধারাবাহিক বিমান হামলা, ভারী অস্ত্রের ব্যবহার এবং নতুন প্রযুক্তির সংযোজন—সব মিলিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ক্ষমতার ভারসাম্য স্পষ্টভাবে জান্তার দিকে ঝুঁকে পড়েছে।
২০২৩ সালের শেষ দিকে উত্তরাঞ্চলের কিয়াউকমে শহরটি দখল করেছিল তাআং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ‘বার্মা রোড’ নামে পরিচিত এশিয়ান হাইওয়ে ১৪–এর পাশে অবস্থিত এই শহরের পতনকে সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়েছিল। তবে চলতি বছরের অক্টোবরেই মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে সেনাবাহিনী আবারও শহরটি পুনর্দখল করে নেয়। টানা বিমান হামলায় শহরটির বড় অংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, ৫০০ পাউন্ডের বোমা, ড্রোন ও কামান ব্যবহার করে টিএনএলএর অবস্থানে হামলা চালানো হয়েছে।
টিএনএলএর মুখপাত্র তার-পান লা জানিয়েছেন, কিয়াউকমে ও হিসপাও এলাকায় প্রতিদিনই সংঘর্ষ চলছে। সেনাবাহিনী হিসপাও শহরটিও পুনর্দখল করেছে, যার ফলে চীনা সীমান্তে যাওয়ার প্রধান সড়কটি এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে।
বিশ্লেষকদের মতে, সেনাবাহিনীর এই পুনরুত্থানের মূল চালিকা শক্তি চীন। ডিসেম্বরের প্রস্তাবিত নির্বাচনের আগে জান্তা সরকারকে সমর্থন দিয়ে চীন তাদের অবস্থান সুসংহত করছে। এই নির্বাচনে অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসিকে বাদ দেওয়া হয়েছে, যা সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক কৌশলের অংশ বলে মনে করা হচ্ছে।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেনাবাহিনী এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রস্তুত। চীনের তৈরি হাজার হাজার ড্রোন, মোটরচালিত প্যারাগ্লাইডার এবং রাশিয়া ও চীনের সরবরাহ করা যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে তারা ধারাবাহিকভাবে বোমা বর্ষণ করছে। এতে বহু বেসামরিক নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন।
অন্যদিকে, প্রতিরোধ বাহিনীগুলো এখন দুর্বল ও বিভক্ত। শত শত ‘পিপলস ডিফেন্স ফোর্স’ গঠিত হলেও তাদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থার অভাব এবং জাতীয় ঐক্য সরকারের নেতৃত্ব মানতে না চাওয়ার কারণে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি।
২০২৩ সালের ‘অপারেশন ১০২৭’-এর সময় ‘ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ নামে তিনটি জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বড় আক্রমণ চালিয়ে প্রায় ১৮০টি ঘাঁটি দখল করেছিল। তখন অনেকেই জান্তা সরকারের পতনের সম্ভাবনা দেখেছিলেন। কিন্তু সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেনি বিদ্রোহীরা।
গবেষক মরগান মাইকেলস বলেন, “সেনাদের মনোবল তখন দুর্বল ছিল, কিন্তু নেতৃত্বে ভাঙন ছিল না।” ২০২৪ সালের শুরুতে সেনাবাহিনী জোরপূর্বক সৈন্য সংগ্রহ শুরু করে, যার ফলে ৬০ হাজারের বেশি তরুণ বাহিনীতে যোগ দেয় এবং যুদ্ধের গতি পাল্টে যায়।
বিশ্লেষক সু মোনের মতে, একের পর এক ড্রোন হামলায় বিদ্রোহীরা বড় ক্ষতির মুখে পড়েছে। চীনের সীমান্তে কঠোর নজরদারি এবং দ্বৈত প্রযুক্তি পণ্যের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রতিরোধ বাহিনীগুলোর ড্রোন সংগ্রহও কঠিন হয়ে পড়েছে।
চীনের চাপেই এমএনডিএএ ও ইউডব্লিউএসএ-এর মতো বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে, কারণ তারা সীমান্ত বাণিজ্যের জন্য চীনের ওপর নির্ভরশীল। একই সময়ে দক্ষিণের কারেন রাজ্যেও সেনাবাহিনী সীমান্ত সড়ক পুনর্দখল করেছে।
চীন প্রকাশ্যে জানিয়েছে, “আমরা মিয়ানমারে বিশৃঙ্খলা চাই না।” বিশ্লেষকদের মতে, বেইজিং জান্তা সরকারকে পছন্দ না করলেও রাষ্ট্র ভেঙে পড়ার আশঙ্কায় তাদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
তবে এই সামরিক পুনরুত্থানের বিপরীতে মিয়ানমারের জনগণের ওপর ভয়াবহ দমননীতি চলছে। এক লাখেরও বেশি ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, প্রায় প্রতিটি পরিবার কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। গবেষক মাইকেলসের ভাষায়, “রাজনৈতিক সমঝোতা এখনো অনেক দূরের স্বপ্ন।
অনলাইন ডেস্ক 













