
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কুমিল্লা-৭ (চান্দিনা) আসনটি এখন আলোচনার কেন্দ্রে। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক তফসিল ঘোষণার তোড়জোড়ের মধ্যেই এই আসনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের প্রার্থী কে হচ্ছেন—এ নিয়ে চলছে তীব্র জল্পনা-কল্পনা। একদিকে জোটের পুরনো শরিক লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদের সম্ভাব্য টিকিটপ্রাপ্তি, অন্যদিকে বিএনপির দুই প্রভাবশালী স্থানীয় নেতার অনমনীয় অবস্থান—সব মিলিয়ে চান্দিনার নির্বাচনী মাঠে এখন উত্তেজনা তুঙ্গে।
দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে জোর তদবির চালাচ্ছেন একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী। পাশাপাশি গণসংযোগ, পথসভা ও কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছেন তারা।
জোটের টিকিটে রেদোয়ান: প্রতীকের চ্যালেঞ্জ
রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন, বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে আসন বণ্টন হলে চান্দিনায় জোটের পক্ষ থেকে মনোনয়ন পেতে পারেন এলডিপি মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. রেদোয়ান আহমেদ। তিনি এই আসন থেকে চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন এবং দুবার প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। জোটের প্রধান শরিক হিসেবে ড. রেদোয়ান মনোনয়ন পেলেও এবার তাকে একটি নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে।
সর্বশেষ আরপিও (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ) সংশোধনের ফলে জোটের প্রার্থী হলেও এলডিপিকে তাদের নিজস্ব প্রতীক ‘ছাতা মার্কা’ নিয়ে নির্বাচন করতে হবে। এর ফলে ঐতিহ্যবাহী ‘ধানের শীষ’ প্রতীকটি চান্দিনার ভোটারদের সামনে থাকবে না, যা ভোটের রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
ড. রেদোয়ান আহমেদ, এলডিপি মহাসচিব, এই প্রসঙ্গে জানান, “২০১২ সাল থেকে আমরা বিএনপির ২০ দলীয় জোটে ছিলাম এবং সকল আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছি। আমার বিশ্বাস, এই আসনে জোটের প্রার্থী হিসেবে আমিই মনোনয়ন পাবো। আমরা চান্দিনার বিএনপির ভাইদের সাথে সবসময় ভ্রাতৃত্বসুলভ আচরণ বজায় রেখেছি।”
বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব: অনড় দুই নেতা
জোটের সম্ভাব্য প্রার্থী নিয়ে আলোচনা চললেও স্থানীয়ভাবে বিএনপির দুই নেতা দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার আশা ছাড়ছেন না। তারা হলেন চান্দিনা উপজেলা বিএনপি সভাপতি আতিকুল আলম শাওন এবং জাতীয়তাবাদী কৃষকদল কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জি. কাজী সাখাওয়াত হোসেন।
এই দুই নেতাই নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে নিরলসভাবে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। তারা পথসভা, কর্মী সম্মেলন, এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ৩১ দফা বাস্তবায়নে লিফলেট বিতরণের মাধ্যমে প্রতিদিন ওয়ার্ড থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন।
উপজেলা বিএনপি সভাপতি আতিকুল আলম শাওন জানান, “চান্দিনার নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ ভোটাররা ধানের শীষ প্রতীকে ভোট দেওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। ১৭ বছরের লালিত স্বপ্ন পূরণে তারা ধানের শীষকেই বেছে নেবেন। আমরা আশাবাদী, তারেক রহমান জনগণের এই প্রত্যাশা পূরণে গুরুত্ব দেবেন।”
তবে আতিকুল আলম শাওনের সমর্থিত নেতা-কর্মীরা ইঙ্গিত দিচ্ছেন যে, তিনি দলীয় মনোনয়ন না পেলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে পারেন। যদি এমনটি হয়, তবে চান্দিনার নির্বাচনে ‘ধানের শীষ’ প্রতীকটি অনুপস্থিত থাকবে, যা এই আসনের ভোটের হিসাবকে আরও জটিল করে তুলবে।
অন্যদিকে, ইঞ্জি. কাজী সাখাওয়াত হোসেন নিজের রাজনৈতিক ত্যাগের কথা তুলে ধরে বলেন, “ছাত্রদলের রাজনীতি দিয়ে আমার পথচলা শুরু। ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে বহু মামলা-হামলার শিকার হয়েছি এবং কারাভোগও করেছি। আমি আবারও দলের স্বার্থেই প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি এবং মনোনয়নের প্রত্যাশা করছি।
এই আসনে ইসলামী ঘরানার দলগুলোর মধ্যেও প্রথমে একাধিক প্রার্থীর ঘোষণা ছিল। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস এবং বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস পৃথকভাবে তাদের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছিল।
তবে, গত ২২ নভেম্বর এই চারটি দলের প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের এক সমঝোতা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের প্রতি আনুগত্য রেখে তারা সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে একজন প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবেন।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী মাওলানা মোশারফ হোসেন জানান, “আমরা চার দলের প্রার্থীরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, কেন্দ্র যাকে মনোনয়ন দেবে, আমরা সকলে তার পক্ষে একযোগে কাজ করব। আমাদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই এবং থাকবে না।”
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর প্রার্থী মুফতী এহতেশামুল হক কাসেমীও এই ঐক্যের কথা নিশ্চিত করে বলেন, “গত ২২ নভেম্বরের সভায় আমরা একজন প্রার্থীকে নিয়ে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কেন্দ্র যাকে সমর্থন দেবে, আমরা তাকে নিয়েই মাঠে নামব।
কুমিল্লা-৭ আসনে জোট এবং অভ্যন্তরীণ উভয় পক্ষেই প্রার্থী নির্বাচন নিয়ে শেষ মুহূর্তের তোড়জোড় চলছে। ড. রেদোয়ান আহমেদ দ্রুত প্রার্থী ঘোষণা করে সকল রাগ-অভিমান নিরসনের প্রত্যাশা ব্যক্ত করলেও, স্থানীয় বিএনপির নেতারা ‘ধানের শীষ’ প্রতীক ধরে রাখার জন্য কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন। চান্দিনার নির্বাচনী রাজনীতিতে শেষ হাসি কে হাসেন, তা দেখতে এখন শুধু কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের দিকেই তাকিয়ে আছেন দলগুলোর নেতা-কর্মী ও সাধারণ ভোটাররা।
অনলাইন ডেস্ক 


















