
২১ সেপ্টেম্বর ঐতিহ্যবাহী ধামতী ইসলামিয়া কামিল মাদরাসার সাবেক উপাধ্যক্ষ ও শায়খুল হাদিস মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাইল টুমচরী (রহ.)-এর ৩২তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন। প্রখর মেধা ও ধীশক্তির অধিকারী এই মনীষী তার ৫৩ বছরের জীবন পঠন পাঠন ও জ্ঞান গবেষণায় অতিবাহিত করেছেন।
বাংলাদেশে যে সকল মহান মনীষী নীরবে-নিভৃতে ইলমে হাদিসের শিক্ষাদান করে গেছেন, এমনই একজন নীরব সাধক হলেন মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাইল টুমচরী (রহ.)। তিনি লক্ষীপুর জেলার সদর উপজেলাধীন টুমচর গ্রামে ০১ মার্চ, ১৯৪০ সালে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মুনসী নূর আহমদ। তিনি শৈশবে বাড়ির মক্তবেই শিক্ষা জীবন শুরু করেন। মক্তবের শিক্ষা শেষে তাঁকে নিজ গ্রামের বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান টুমচর ইসলামিয়া সিনিয়র মাদরাসায় ভর্তি করা হয়। মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাইল টুমচরী (রহ.) ছোটকাল থেকেই আদব-আখলাকে সচ্চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। যারা কারণে তিনি মাদরাসার সকল উস্তাদের নজরদারীতে পড়াশনায় মেধার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। এ মাদরাসা হতে তিনি ১৯৫৭ সালে দাখিল, ১৯৬১ সালে আলিম এবং ১৯৬৩ সালে ফাজিল পরীক্ষায় ১ম বিভাগে ১ম স্থান অধিকার করে কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। এরপর তিনি ছারছিনা দারুচ্ছুন্নাত আলিয়া মাদরাসায় কামিল শ্রেণিতে হাদিস বিভাগে ভর্তি হন। এ মাদরাসা হতে তিনি ১৯৬৫ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে কামিল পাশ করেন। তিনি এখানে যুগশ্রেষ্ঠ আলেম, উপমহাদেশের প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ আল্লামা নিয়াজ মাখদুম খোতানী (রহ.)-এর নিকট হাদিস শিক্ষালাভ করেন।
মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাইল টুমচরী (রহ.) কৃতিত্বপূর্ণ ছাত্রজীবন শেষ করার পর টুমচর ইসলামিয়া সিনিয়র মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। শিক্ষকতায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত যত্নবান। তরুণ শিক্ষক হিসেবে চতুর্দিকে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। অল্প সময় এখানে শিক্ষকতা করার পর তিনি কুমিল্লা জেলার ঐতিহ্যবাহী ধামতী ইসলামিয়া কামিল মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যক্ষ পীরে কামেল মাওলানা মুহাম্মদ আজীম উদ্দীন আহমদ (রহ.)-এর আহবানে সাড়া দিয়ে ১৯৬৭ সালে উক্ত মাদরাসায় প্রধান মুহাদ্দিস হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৮১ সালে তিনি ধামতী ইসলামিয়া কামিল মাদরাসার উপাধ্যক্ষ হিসেবে পদোন্নতি পান। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রায় ২৭ বছর তিনি এ মাদরাসায় ইলমে হাদিসের দারস প্রদান করেন। সারাদেশে ধামতী ইসলামিয়া কামিল মাদরাসার অধিকতর সুখ্যাতির কারণ ছিলেন মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাইল টুমচরী (রহ.)। ধামতী এলাকাটি ছিল অনুন্নত পল্লী অঞ্চল। এর যোগাযোগ ব্যবস্থাও ছিল খুবই দুর্গম। এতদসত্ত্বেও দক্ষ মুহাদ্দিস হিসেবে মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাইল টুমচরী (রহ.)-এর খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ায় তাঁর নিকট হাদিস শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে দূর-দূরান্ত থেকে অসংখ্য ছাত্র ধামতী ইসলামিয়া কামিল মাদরাসায় এসে সমবেত হয়। তিনি এখানে প্রধানত সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিমের পাঠদান করতেন।
তিনি কত গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন তা তাঁর ছাত্ররা ছাড়া অন্যদের পক্ষে বুঝা কঠিন ব্যাপার। এছাড়াও তাঁর পাঠদানের পদ্ধতি ছিল অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। সহজ-সরল উপস্থাপনা, সারগর্ভ বক্তব্যে তাঁর তাকরির ছিল পরিপূর্ণ। তাঁর গভীর জ্ঞান ও উন্নত পাঠদানের প্রভাবে ধামতী ইসলামিয়া কামিল মাদরাসার বহু ছাত্র মাদরাসা বোর্ডের কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় অসাধারণ কৃতিত্ব প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়। ১৯৮৮ সালে এ মাদরাসা চট্টগ্রাম বিভাগের অধীনে শ্রেষ্ঠ মাদরাসার পুরস্কার লাভ করে। ১৯৯৩ সালে এ মুহাদ্দিস বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে স্বর্ণপদক লাভ করেন।
মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাইল টুমচরী (রহ.)-এর উন্নত পাঠদানের প্রভাবে অগণিত লোক নিজেদেরকে যোগ্য আলেম হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হন। দেশে-বিদেশে তাঁর অসংখ্য ছাত্র ইসলামের সেবায় নিয়োজিত আছেন। তাঁর ছাত্রগণ দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম, ইসলামি চিন্তাবিদ, অধ্যক্ষ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির, মুফতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, রাজনীতিবিদ এবং পদস্থ সরকারী আমলা হিসেবে বেশ সুনাম ও সুখ্যাতির সাথে দেশ ও জাতির সেবায় নিয়োজিত আছেন। একজন বিজ্ঞ হাদিসবিদ ও আদর্শ শিক্ষক হিসেবে মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাইল টুমচরী (রহ.) ছিলেন উজ্জ্বল খ্যাতির অধিকারী।
ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন সরল, বন্ধুবৎসল, উদার, বিনয়ী, কষ্টসহিষ্ণু ও অনুপম চরিত্রের অধিকারী। মানুষকে সহজে আপন করে নেয়ার মহৎ গুণ ছিল তার। তাকওয়া, পরহেজগারি ও আতিথ্য ছিল তার জীবনের অনন্য বৈশিষ্ট্য। জীবনের কোনো মুহূর্ত তিনি হেলা ও অবহেলায় নষ্ট করেননি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইলমে হাদিসের এই মহান সাধককে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন। আমিন!
লেখকঃ
পরিচালক, বেতুয়া হাশেমিয়া দারুস সুন্নাহ মাদরাসা, দেবিদ্বার, কুমিল্লা।
Reporter Name 














