
বিশেষ প্রতিনিধিঃ
দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে আগামী মঙ্গলবার বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে লন্ডন থেকে দেশে ফিরছেন ডা. জুবাইদা রহমান। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সহধর্মিণীর দীর্ঘ ১৭ বছর পর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খবরে রাজধানী ঢাকা সহ সারা দেশের বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে এক অভূতপূর্ব আনন্দ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। একইসঙ্গে, দলের অনেক নেতাকর্মীর মনে জুবাইদা রহমানের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়েও কৌতূহল দেখা দিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘ বিরতির পর ডা. জুবাইদা রহমানের আগমন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আগ্রহের জন্ম দেবে। তিনি সরাসরি রাজনীতিতে অংশ নিলে তা নিঃসন্দেহে জাতীয় রাজনীতিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করবে। এমনকি সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করলেও, দেশে তার উপস্থিতি জাতীয়তাবাদী শিবিরে নতুন প্রেরণা সঞ্চার করবে বলে মনে করছেন অনেকে।
জানা গেছে, ডা. জুবাইদা রহমান আপাতত ঢাকায় এক থেকে দুই মাস অবস্থান করবেন। এই সময়কালে তিনি দলীয় কোনো কর্মসূচিতে সরাসরি অংশ না নিয়ে মূলত তার শাশুড়ি খালেদা জিয়া ও মায়ের সঙ্গে সময় কাটাবেন এবং তাদের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেবেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল এই প্রসঙ্গে বলেন, “ডা. জুবাইদা রহমান শুধু জিয়া পরিবারের সদস্য নন, তার বাবাও ছিলেন এ দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর একজন সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি অত্যন্ত সম্মানের পাত্র ছিলেন। অথচ কোনো প্রকার অপরাধ ছাড়াই শুধুমাত্র ফ্যাসিবাদের রোষানলে পড়ে ডা. জুবাইদাকে এত দীর্ঘ সময় ধরে দেশের বাইরে থাকতে হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “যখন কোনো পাখিকে খাঁচা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়, তখন তার মধ্যে যেমন ওড়ার অদম্য শক্তি থাকে, তেমনি থাকে অনাবিল আনন্দ এবং দিগন্তের পথে উড়ে যাওয়ার এক প্রবল আকাঙ্ক্ষা। ডা. জুবাইদা রহমানের মধ্যে আজ সেই সবকিছুই বিদ্যমান। সেই কারণেই এত বছর পর তিনি দেশে ফিরতে পারছেন। এতে তিনি যেমন আনন্দিত, তেমনি বিএনপির নেতাকর্মীরাও তাকে বরণ করে নেওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।”
জুবাইদা রহমানের রাজনীতিতে যোগদান প্রসঙ্গে আলাল বলেন, “এটি সম্পূর্ণভাবে তার ব্যক্তিগত অথবা তাদের পারিবারিক সিদ্ধান্তের বিষয়। তবে যদি তিনি রাজনীতিতে আসেন, তাহলে জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী মানুষ অবশ্যই অত্যন্ত খুশি হবে।
জিয়া পরিবারের সদস্যদের মধ্যে নেতৃত্বের যে সহজাত গুণাবলী রয়েছে, তার সঙ্গে যুক্ত হবে আরও একটি নতুন উপাদান, যা বিএনপির নামের সঙ্গে যোগ করবে সম্মানের আরেকটি পালক। এর মাধ্যমে বিএনপি দেশের রাজনীতিতে তারুণ্যকে আরও বেশি উৎসাহিত করবে এবং যুবকদের দলে অংশগ্রহণের জন্য আরও জোরালো আহ্বান জানাবে।”
উল্লেখ্য, ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে শিক্ষা ছুটি নিয়ে স্বামী তারেক রহমানের চিকিৎসার জন্য মেয়ে জায়মা রহমানকে সঙ্গে নিয়ে লন্ডনে যান ডা. জুবাইদা রহমান। এরপর দীর্ঘ ১৭ বছর তিনি আর দেশে ফিরতে পারেননি। বিএনপির নেতাকর্মীদের অভিযোগ, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কারণেই তিনি এতদিন দেশে ফিরতে পারেননি।
তারেক রহমানের বিরুদ্ধে যেমন মিথ্যা মামলা ও চক্রান্ত ছিল, তেমনি তার সহধর্মিণীও সেই পরিস্থিতির শিকার। দুদকের একটি মামলায় ২০২৩ সালে ঢাকার একটি আদালত জুবাইদা রহমানকে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড প্রদান করে। তবে গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটলে জুবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে বিচারিক আদালতের সেই সাজা স্থগিত করা হয়। এরপর অবশেষে শাশুড়ি খালেদা জিয়ার সঙ্গে তিনি দেশে ফিরছেন।
এর আগে, উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ৮ জানুয়ারি কাতার আমিরের পাঠানো বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে লন্ডন যান খালেদা জিয়া। সেখানে পৌঁছে লন্ডন ক্লিনিকে ভর্তি হন তিনি। টানা ১৭ দিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক প্যাট্রিক কেনেডি ও অধ্যাপক জেনিফার ক্রসের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন ছিলেন খালেদা জিয়া।
পরে ২৫ জানুয়ারি থেকে তিনি বড় ছেলে তারেক রহমানের বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। দীর্ঘ সময় পর এবারই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
ডা. জুবাইদা রহমানের জন্মস্থান সিলেট জেলা। তিনি প্রয়াত রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলীর কন্যা। মাহবুব আলী সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সরকারে তিনি যোগাযোগ ও কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্বেও ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানী ছিলেন জুবাইদা রহমানের চাচা।
জুবাইদা রহমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস এবং লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে মেডিসিনে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯৫ সালে বিসিএস পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগদান করেছিলেন। তবে ২০০৮ সালে শিক্ষা ছুটি নিয়ে লন্ডনে যাওয়ার পর দ্বিতীয় দফায় ছুটির মেয়াদ বাড়ানোর পরও কর্মস্থলে যোগদান না করায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাকে বরখাস্ত করে। বিএনপির অভিযোগ, সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণেই তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
যদিও ডা. জুবাইদা রহমান সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন, তবে তিনি বরাবরই স্বামী তারেক রহমানের একজন শক্তিশালী সহায়ক হিসেবে কাজ করে গেছেন। এছাড়া, বিভিন্ন সময়ে বাবা মাহবুব আলীর মৃত্যুবার্ষিকী এবং জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাকে দেখা গেছে। তিনি জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের ওভারসিজ কমিটির প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান মনে করেন, “মূলত বেগম খালেদা জিয়াকে সঙ্গ দেওয়ার জন্যই ডা. জুবাইদা রহমান এখন দেশে আসছেন। দীর্ঘ অসুস্থতার পর ম্যাডাম লন্ডন থেকে ফিরে আসছেন, তাই তার শারীরিক সুস্থতা এবং যত্ন নেওয়া এখন প্রধান বিবেচ্য বিষয় হতে পারে।
তবে এর পেছনে একটি রাজনৈতিক ভাবনাও থাকা অস্বাভাবিক নয়। যেহেতু তিনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সহধর্মিণী এবং দীর্ঘ সময় পর দেশে আসছেন, তাই তার আগমনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি হবে।
তিনি আরও বলেন, “ডা. জুবাইদা রহমান সরাসরি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করলেও, দেশে তার উপস্থিতি জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করবে। ম্যাডামের সুস্থতা এবং পাশে পুত্রবধূর উপস্থিতি নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুন করে উৎসাহ ও ঐক্য তৈরি করবে। ফরমালি না হলেও, এটা ইনফরমালি একটি স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করবে। আর যদি তিনি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন, তবে তা নিঃসন্দেহে দেশের রাজনীতিতে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে।
এদিকে, ডা. জুবাইদা রহমানের দেশে ফেরার পর তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিএনপি। গত বুধবার দলের পক্ষ থেকে পুলিশের মহাপরিদর্শককে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসনের একান্ত সচিব এবিএম আব্দুস সাত্তার স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে জুবাইদা রহমানের জন্য চার স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা চাওয়া হয়েছে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ঢাকায় অবস্থানকালে জুবাইদা রহমান ধানমন্ডিতে তার পৈতৃক বাসভবন ‘মাহবুব ভবন’-এ থাকবেন। জিয়া পরিবারের সদস্য এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সহধর্মিণী হিসেবে তার জীবনের নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে। তাই তার বাসভবনে অবস্থানকালীন এবং চলাচলের সময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। প্রত্যাশিত নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে—একজন সশস্ত্র গানম্যান নিয়োগ, গাড়িসহ পুলিশি প্রটেকশন, বাসায় পুলিশি পাহারা এবং বাসার প্রবেশপথে আর্চওয়ে স্থাপন।
জানা গেছে, দেশে ফিরে ডা. জুবাইদা রহমান প্রথমে শাশুড়ি খালেদা জিয়ার গুলশানের বাসভবনে যাবেন। এরপর তিনি ধানমন্ডিতে তার পৈতৃক বাসভবন ‘মাহবুব ভবন’-এ অবস্থান করবেন।
উল্লেখ্য, জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০২৩ সালে ডা. জুবাইদা রহমানকে তিন বছরের কারাদণ্ড ও ৩৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড প্রদান করে আদালত। ২০০৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কাফরুল থানায় এই মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল। তবে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সেই সাজা স্থগিত করা হয়।
বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল এই প্রসঙ্গে বলেন, “কাফরুল থানার মামলায় ডা. জুবাইদা রহমানকে যে অবৈধভাবে তিন বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে, তার কোনো ভিত্তি ছিল না। ৩৫ লাখ টাকার একটি হিসাবকে কেন্দ্র করে এই অভিযোগ আনা হয়েছিল, যা তিনি তার মায়ের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন। এমনকি মামলা দায়েরের দুই বছর আগে তার ব্যক্তিগত আয়কর নথিতেও এই অর্থ প্রদর্শিত ছিল।
তিনি আরও বলেন, “যে অর্থ আয়কর নথিতে দেখানো হয়েছে, তা কোনোভাবেই অবৈধভাবে অর্জিত হতে পারে না। তা সত্ত্বেও, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে তড়িঘড়ি করে মাত্র নয় দিনের মধ্যে এই মামলার বিচারকার্য সম্পন্ন করা হয় এবং তাকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
দিনের বেলায় সম্ভব না হওয়ায় রাতে মোমবাতি জ্বালিয়ে এই মামলার বিচার শেষ করা হয়। ৫৬ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ১৯ জনকে হাজির করে তারা রায় ঘোষণা করেন। এটি ছিল সম্পূর্ণ ফরমায়েশি এবং অবৈধ একটি রায়।” বর্তমানে এই মামলার সাজা স্থগিত রয়েছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে, খালেদা জিয়া ও জুবাইদা রহমানকে বরণ করে নিতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে বিএনপি। এর অংশ হিসেবে গতকাল দলের পক্ষ থেকে একটি যৌথ সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ব্যাপক শোডাউনের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। এছাড়া, বিমানবন্দর থেকে বেগম জিয়ার গুলশানের বাসভবন ফিরোজা পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে সুশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে নেতাকর্মীরা তাদের অভ্যর্থনা ও শুভেচ্ছা জানাবেন।
Reporter Name 













